আব্দুল বারী :
কৃষক বাবা নাম রেখেছিলেন মোঃ সিরাজুল ইসলাম। পুলিশে আসার পর কেউ বলে পাগলা সিরাজ, কেউ বলে বাঘা সিরাজ, কেউ বলে কালা সিরাজ, কেউ বলে চুদিরভাই সিরাজ, কেউ কেউ বলে বারোচুদি সিরাজ।
এসব বিকৃত নাম শুনে প্রথম প্রথম খারাপ লাগতো। এজন্য অনেককে ধরে নিয়ে মারপিটও করেছি। তাতে কাজ হয়নি। বিকৃত নাম ঠেকাতে যত বাড়াবাড়ি করেছি তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সেটা তার চেয়েও আরো বেশি।
তাই এনিয়ে আর ভাবি না। যার যা ইচ্ছে সে তাই বলেই ডাকুক। এই বলে মনকে সান্তনা দিয়েছি। আমাকে কি নামে কে অভিহিত করেছে তা নিয়ে আর ভাবি না।
এসব বিষয় মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারলেও পুলিশের একটা নীতিবাক্য ঝেড়ে ফেলতে পারনি। সেটা হলো এই যে “দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন”।
এই নীতিবাক্য পালনের খেসারতে বহুবার সাসপেন্ড হয়েছি। সার্ভিস বুক লাল দাগে ভরে নিয়েছি। মেধা শ্রম ও কর্তব্যনিষ্ঠা দিয়েও ইউনিফর্মের সোল্ডারে ধাতব অলঙ্কারের ওজন বাড়াতে পারিনি।
পুলিশি জীবনে আছে তো অনেক গল্প। কোনোটাই কম নয়। কোনটা রেখে কোনটা যে বলি তা ঠিক করাও কঠিন কাজ।
একটা ঘটনার কথা বলিঃ
স্বাধীনতা পরবর্তী কোন এক সরকারের আমলে পোস্টিং হয় মাগুরা সদরে। তখন মাগুরায় ছিলো এক ডাকসাইটে মন্ত্রীর নিবাস। তার দাপটে বাঘে বকরীতে পানি খেত এক ঘাটে। অত্যাচারে তার চেয়েও দুইকাঠি নয়, তিন কাঠি উপরে ছিলো তার ভাই ব্রাদাররা। সকালে একে মারছে তো বিকেলে আরেক জনকে পেটাচ্ছে। রাতে দিনে যখন যাকে ইচ্ছা ধরে নিয়ে যেত। তাপর কি হতো তা তো কারোরই অজানা নয়।
এসব নিয়ে কেউ থানায় গেলে অত্যাচার আরো বেশি করতো। এক কথায় তাদের দাপটে ডিসি হয়ে থাকতো সার্কেল অফিসার (ডেব)। আর এসপি সার্কেল অফিসার (রেভ)। কেন রেভ বললাম তা বলবো আরেক গল্পে।
এই দুই নিচের সবাই কেবলমাত্র বিড়াল নয়, মেকুরের ছা হয়ে চাকরি করতো ।
আমিও সেই দলেই থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নীতি বাক্যের ঠেলায় ঠিক থাকতে পারতাম না। তারপরও নিজেকে ক্ষমতার বিপরীতে না দাঁড় করিয়ে মনকে বেঁধে রাখতাম। কানে তুলা আর চোখে ঠুলি সেঁটে চলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তাতেও বিপদ এড়ানো গেলোনা।
একদিন বিকেলে তাঁর দপ্তরে ডেকে পাঠালেন এসপি। গিয়ে দেখলাম ওই মন্ত্রীর ভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে এসেছেন এক ব্যাক্তি। বিষয়টি দেখার জন্য বললেন এসপি। এরই মধ্যে খবর এলো মন্ত্রীর ভাই একজনকে পেটাচ্ছে। এসপি বললেন, যাও। এই সুযোগ। মন্ত্রীর ভাইকে সায়েস্তা করে দাও।
উর্ধতনের হুকুম তামিল করতে হান্ড্রেট টেন হোন্ডা হাঁকিয়ে “দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন” মন্ত্র পাঠ করে গেলাম ঘটনাস্থলে।
হোন্ডা থেকে নামতেই ছুটে এলো মন্ত্রীর সেই ভাই। বললো, এই চুদিরভাই সিরাজ, তোকে এখানে আসতে বলেছে কে? শীঘ্রি থানায় চলে যা। না গেলে ঠ্যাং ভেঙে গলায় বেঁধে দেব। কি আর করা তার আগেই আমি তার ঠ্যাং ভেঙে মাটিতে শুইয়ে দিলাম।
সন্ধ্যার পরই আর ও অফিস থেকে এলো পাতলা একখান কাগজ। তাতে এসপি সাহেব লেখেছেন শহরের একজন এলিটকে মেরে অঙ্গহানি করে দিয়ে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছেন। তাই সেকেন্ড অফিসারের কাছে চার্জ বুঝিয়ে দিয়ে আগামী কাল সকাল ১০ টার মধ্যে পুলিশ সুপারের অফিসে রিপোর্ট করবেন।
পরদিন এসপি সাহেবকে বললাম স্যার, আমার কি অপরাধ ? আপনার নির্দেশই তো কাজটা করেছি। তিনি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বললেন আমি বলেছি বিষয়টি দেখতে, আর তুমি তার পা ভেঙে দিয়েছ। এটা করার কি দরকার ছিলো!
অল্প শোকে কাতর না হয়ে অধিক শোকে পাথর হয়ে গেলাম। জুতা খুলে গালে ঠাস ঠাস করে মারলাম আর বললাম ‘সিরাজ, আসলেই তুই একটা হারামজাদা। তোর বাপ ধান বেচে লেখাপড়া শিখিয়ে ভুল করেছে। তুই একটা গাধা। এসপি যাকে বাপ ডাকে তুই তাকে খালু বললেও সাসপেন্ড হতিস না। কি আর করা খাট, সাজা খাট।
এরপর তিন মাস চাকরি ছিলো না।
লেখক: আব্দুল বারী , সিনিয়র সাংবাদিক।
(তথ্য সহযোগীতায় সাবেক পুলিশ পরিদর্ক মো: সিরাজুল ইসলাম)
Leave a Reply